মেলা হলো মানুষের মিলনস্থল। পবিত্র দোল পূর্ণিমার আগের দিন থেকে কামনা ও মিলনের আকাঙ্ক্ষায় দূরদূরান্ত থেকে নদীয়ার অন্তর্গত কল্যাণীর ঘোষপাড়ায় একেবারে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী স্থানে কত যে মানুষ আসে তার ইয়ত্তা নেই। চলতি নাম সতী মায়ের মেলা। আবার দোল মেলা, ঘোষপাড়া মেলা , বাইশ ফকিরের মেলা ইত্যাদি নামেও চল রয়েছে। ভক্তসমাগমে যথার্থভাবেই মিলনমেলার রূপ নাই এই মেলা। সব ধর্মের মানুষরা এখানে আসেন। কোন ধর্মীয় বাধা-নিষেধ নেই, নেই কোন জাতের বাঁচ বিচার, আর না কোন ধরনের আছে বেড়াজাল। আছে শুধু সর্বধর্মসমন্বয়ী অপার আকুতি। এখানে খোঁজ চলে ” সহজ মানুষের “। বাউল, ফকির, সাহেব ধনী, বলাহারি – এইসব লোকিক ধর্ম সম্প্রদায়ের মত ” সহজ মানুষের” ধর্ম কর্তাভজা ধর্ম সম্প্রদায়ের সাধনাতে মানুষই বড় হয়ে উঠেছে, দেবদেবীর মূর্তির চেয়ে। এ সাধনার মূল কথা হলো – ” মানুষ হয়ে মানুষ জানো / মানুষ হয়ে মানুষ মানো / মানুষ সাধন ধন / করো সেই মানুষের অন্বেষণ “।
মানুষের সাধনা চলে কর্তা ভজা ধর্ম সম্প্রদায়ের পিঠস্থান বা সাধনা পিঠ ঘোষপাড়ায়। কর্তা অর্থাৎ ভুবনের নিয়ন্ত্রককে ভজনা করাই হলো কর্তা ভজা। সহজ ভাবে বললে বোঝায় কর্তাকে যে ভজনা করে সেই কর্তা ভজা। সত্যিই কত সহজ ও সুন্দর ভাবনা। গানই এই সাধন পদ্ধতির মূল মন্ত্র। “ভাবের গীত “ হল কর্তা ভজা ধর্ম সম্প্রদায়ের ভজনার গান। ভাবের জিতের মাধ্যমে এই সম্প্রদায়ের সাধন পথের কথা কত সহজভাবে ধরা পড়েছে : ” আছে কর্তা ভজা, এক মজা সত্য উপাসনা, ভেদ-বিধিতে নাইকো তার ঠিকানা / এসব চতুরের কারখানা “।
মেলার সময় ভাবের গানের আসর বসে মেলা প্রাঙ্গণে। মেলার শুরুর দিন থেকে তিন দিন ধরে দিন রাত চলে ভাবের গীতের আখড়া। ফকির দরবেশ বাউল এর আখড়া ও রাত জেগে চলে। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাধুসন্ত বাউল ফকিররা আসেন। আখড়া চলায় মেলা চত্বরে। ভক্ত সন্নিবেশে গানের পাশাপাশি চলে সাধনা। তবে ধর্ম সাধনার ভাবনা সহজ হলেও সাধন পদ্ধতির ক্ষেত্রে গোপনতা রয়েছে। সেই জন্যই সাধকেরা বলেন-
” আপনভজন কথা, না কহিও যথা তথা “।
কর্তা ভজা ধর্ম মতের প্রবর্তক হলেন আউলচাঁদ নামে এক ফকির। অনেকে তাকে চৈতন্যদেবের অবতার বলে থাকেন। তার ২২ জন ফকির ছিল বলে ধারণা। সেই ২২ জন ফকিরের প্রধানতম শিষ্য ছিলেন রামশরণ পাল। আর রামশরণ পালের স্ত্রী হলেন সরস্বতী দেবী। তিনিও স্বামীর সঙ্গে সাধন-ভজন করতেন। তিনি ভক্তদের কাছে সতী মা বা কর্তা মা নামে পরিচিত। সরস্বতী দেবীর পুত্র রামদুলাল পাল বা দুলাল চাঁদের মৃত্যু হলে তার স্মরণে সবার কর্তমা দোল মেলার সূচনা করেন, যা সতী মায়ের মেলা নামে পরিচিত।
মেলার সময় ভক্তরা মায়ের বাড়িতে আসেন এবং পূজা দেন। কামনা পূরণের আশায় ডালিম গাছে মাটির তৈরি ঘোড়া বাঁধেন। এগুলিকে “ছলন” বলে। ভক্তবৃন্দ ছলনকে সাক্ষী রেখে কামনা করেন। আর কামনা পুরনো হয়ে গেলে ডালিম গাছ থেকে কোন না কোন ঘোড়া খুলে দেয় ভক্তরা। ডালিম তলায় সতীমা সিদ্ধিলাভ করেছিলেন বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। তাই এই স্থলকে পরম পবিত্র বলে ভক্তরা মানে : ” ঘোষপাড়া মহৎ নৃত্য দর্শন / ডালিম গাছের তলা পবিত্র মহান / অনন্তে ঐশ্বর্য ভরা মত্তের সিদ্ধ স্থান / মন খাটি করে মাটি মাখি যেই জন / জটিল কুটির রোগ করে প্লয়ন”। কাজেই ডালিম গাছ ও ডালিম তলাকে কেন্দ্র করে রয়েছে নানান লৌকিক প্রথা ও লোকাচারের প্রচলন , যেমন দন্ডি কাটা, ডালিম তলার মাটি মাখা বা খাওয়া, ডালিম তলায় নানা উপাচার দিয়ে পুজো দেওয়া, হিমসাগর নামে এক পবিত্র পুকুরে স্নান করা ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় কথা হল ভক্তরা ভাবেন এবং মানেন : ” যার কেউ নেই, তার সতিমা আছেন” । তিনি সকলের আস্থা, বাঁচা সম্বল।
প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো বলে সতী মায়ের মেলাকে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তবে মেলার পাঁচনত্ত নিয়ে সঠিক সময়কাল নির্ণয় করা খুবই দুষ্কর। কোন ধরনের প্রচার ছাড়াই ভারতে বিভিন্ন প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নির্দিষ্ট দিনে প্রচুর মানুষ আসে এই মেলায়। ওপার বাংলা থেকে ও ভক্তরা আসেন। ভক্তদের আশা শুরু হয় দোল পূর্ণিমার আগে দিন থেকে এবং ভিড় থাকে দোলের পরের দিন পর্যন্ত। মূল মেলা চলে তিন দিন ধরে কিন্তু মেলা চলে প্রায় ১৫ দিন পর্যন্ত। পূর্বে একমাস ধরে মেলা চলত। দিনে দিনে মেলার মধ্যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হল মেলা বসার জন্য অপ্রতুল জায়গা। দিনে দিনে ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে মেলা। এই মেলার অনেকেই বছরভর তাকিয়ে থাকে। কেননা অনেকেরই উপার্জনের উৎস হয়ে উঠে এই মেলা। প্রচুর দোকানপাট বসে, হরেক রকম জিনিসপত্রের বিকিকিনি চলে। পূর্বের মতো স্থানীয় অধিবাসীরা গার্হস্থ্য জীবনের প্রয়োজনীয় উপকরণ এখান থেকে সংগ্রহ করে। উল্লেখ্য লোকশিল্পীরা ও তাদের শিল্প দ্রব্য ক্রেতাদের কাছে বিক্রয় করার সুযোগ পায়। মেলার সময় বহু মানুষ দুটো পয়সার মুখ দেখতে পায়। এই প্রেক্ষিতে অন্যান্য শতাব্দি প্রাচীন মেলার মতো সতিবার মেলাও আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব রয়েছে। কল্যাণী শহরের উপ কন্ঠে এ মেলা বসলে ও মেলার মধ্যে এখনো গ্রামীণ চরিত্র পরিলক্ষিত হয়।
সতী মায়ের বাড়ি, মন্দির, ডালিমতলা পুস্করিণী হিমসাগর – এসবের মাহাত্ম্য মেলার সময় ভক্তবৃন্দ কে কাছে টানে। শুধু ভক্তবৃন্দ হয় কেন ও দেশ-বিদেশি গবেষকরা ও যেমন আসে তেমনি আসেন বহু পর্যটক। যদিও আদর্শ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে যথার্থ পরিকাঠামো এখনো গড়ে ওঠেনি। ফলে অনেক ক্ষেত্রে পর্যটকদের নানান অসুবিধায় পড়তে হয়। তবে কয়েক বছর আগে কল্যাণী পৌরসভা কিছু কিছু পরিকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে। পর্যটনের নিরিখে সুপরিকল্পিতভাবে মন্দির চত্বরের পরিকাঠামগত উন্নয়ন করা জরুরি। সতী মায়ের মাহাত্মক এক কেন্দ্র করে এবং কর্তা ভজা ধর্ম সম্প্রদায়ের সাধন পিঠ হিসেবে ঘোষপাড়া কে “তীর্থস্থান কেন্দ্রিক পর্যটন” ও “সাংস্কৃতিক পর্যটন কেন্দ্র” গড়ে তোলা সম্ভব।
নদিয়া সম্প্রীতির জনপদ। এখানে নানান ধর্মের সন্নিবেশ যেমন ঘটেছে প্রাচীনকাল থেকে বয়ে চলেছে আদিবাসী ও অ-আদিবাসী সংস্কৃতিক মিলন স্রোত । ধর্মীয় ভেদাভেদ ও জাতপাতের বিচার লোক ধর্মের স্থান পায়নি। কর্তা ভজা ধর্মমত ও সতী মায়ের মেলা তারই প্রকৃত দৃষ্টান্ত। আউল চাঁদের 22 জন শিষ্যের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই ছিলেন। সার্থকভাবে ধর্ম সমন্বয়ে সাধন ঘটেছে এই ধরনের নানান লোকিক ধর্ম-সাধনায়। ভজনা চারে অনুমানের চেয়ে বর্তমান বড়। এর জন্যই সাধকেরা বলে- ” নয়নের দেখিনি যারে / কেমনে ভজিব তারে “। সত্যই মূল কথা। তাই এ-ধর্ম “সত্যধর্ম”। মানুষ ভজনার ধর্ম। বর্তমান সময়কালে এ-ভাবনার বড়ই প্রয়োজন।