কোথাও মা দুর্গার সিংহের বদলে ঘোড়া বাহন কোথাও বা বিসর্জনে টিকটিকির আগমন – নদীয়া জেলার বনেদি পুজো

কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পুজো

কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পূজা মণ্ডপ টি সত্যিই এক দর্শনীয় পুরা সম্পদ ।পূজা মণ্ডপের থাম,খিলান পূজার স্থান সব জায়গাতেই এক রাজকীয় ছাপ লক্ষ্য করা যায়। এই পূজা মণ্ডপে মহাসমারোহে প্রতি বছর দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হয়। ঐতিহ্যের টানে বহু মানুষের ভিড় হয় এখানে।এখানকার প্রতিমা রাজরাজেশ্বরী নামে বিখ্যাত। রথের দিন প্রতিমা তৈরি শুরু হয়। মহালয়ার দিন হোমকুন্ড জ্বালিয়ে পুজোর সূচনা করা হয়।একটানা নবমী অবধি জ্বলে।সপ্তমীতে সাত,অষ্টমীতে আট,নবমী তে নয় রকম ভাজা সহযোগে ভোগ নিবেদন করা হয়। দশমীতে জলঙ্গিতে দেবীর বিসর্জন করা হয় , আসছে বছর আবার হবে এই আশায়।


শান্তিপুরের বনেদী বাড়ির পুজো

নদিয়া জেলার শান্তিপুরের গোস্বামী বাড়ির পুজো খুব বিখ্যাত পুজো । এই বাড়ির আরাধ্যা দেবী হলেন কাত্যায়নী দেবী। গোস্বামী বাড়ির পুজো প্রায় চারশো বছরের পুরোনো পুজো। দেবীর এখানে সংহার মূর্তি দুটি হাত বড় আর আটটি হাত ছোট। এই পুজোর এক ইতিহাস আছে, কোন একদিন এই বাড়ির ইস্ট দেবতা রাধারমণের মূর্তি হঠাৎই উধাও হয়ে যায়। বাড়ির মহিলারা তখন বাড়ির উঠোনে দেবী কাত্যায়নীর আরাধনা শুরু করেন। তিন দিন পর বাড়ির বয়জ্যেষঠা স্বপ্ন পান রাধারমণের মূর্তি কোথায় আছে ,এবং পেয়েও যায়। তখন থেকেই কাত্যায়নীর পুজো শুরু হয় নদীয়ার শান্তিপুরের গোস্বামী বাড়িতে।
এই বাড়ির পুজোর আর একটি বৈশিষ্ট্য আছে এখানে গণেশ ও কার্তিক বিপরীত স্থানে অবস্থান করে কিন্ত নব পত্রিকা সঠিক স্থানে অবস্থান করে আর সিংহের পরিবর্তে ঘোড়া দেবীর বাহন। এই বাড়ির পুজোর ভোগের এক বিশেষ নিয়ম আছে বিবাহিত দীক্ষিত মহিলারা একমাত্র ভোগ রান্না করেন। অবিবাহিত মহিলারা অনান্য কাজে সাহায্য করে। এই পুজোর মাধ্যমেই পরিবারের মানুষ একসাথে বাঁধা পরে বছরের এই সময় টাতে।


নদিয়ার বনেদী চার বাড়ির পুজো

নদিয়া জেলার বেলপুকুর গ্রামের বনেদী বাড়ির দুর্গাপুজোর এক ইতিহাস আছে। কথিত আছে রাজা কৃষ্ণ চন্দ্রের প্রপিতামহ রুদ্রের সময় ঢাকা বিক্রম পুর থেকে এক তন্ত্র সাধক এসে এই বেলপুকুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন । ওনার নাম ছিল রামচন্দ্র ভট্টাচার্য্য। এই রামচন্দ্রের প্রপৌত্র রঘুরাম বিদ্যা বাচস্পতি বেলপুকুর গ্রামে প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। রঘুরামের ছিল চার ছেলে। পরবর্তী সময়ে তার চার ছেলে আলাদা আলাদা করে পুজো শুরু করেন। সেই কারণেই চার বাড়ির পুজো নামেই খ্যাত ছিল। এই চার বাড়ির পুজো প্রায় আড়াইশো বছরের ও বেশি পুরোনো। এই বাড়ির পুজোর কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে।
বড় ছেলের বাড়ির পুজোর দুর্গার দশটি হাত ই সমান। কিন্ত ন বাড়ির আর ছোট বাড়ির দুর্গার দুটি হাত বড়, বাকি আটটি হাত ছোট। এর অর্থ হিসাবে ছোট বাড়ির বর্তমান প্রজন্ম অত্রি ভট্টাচার্য্য এর কাছ থেকে জানা যায় যে মা দুর্গা তাদের কাছে বাড়ির গৃহিনী তাই আটটি হাত ছোট। আবার বড় বাড়ির দুর্গার দশটি হাত বড় হওয়ার কারণ হিসাবে জানা যায় যে বাড়ির বড় সবাই কে দশ হাত দিয়ে রক্ষা করছেন তিনি, তিনিই যোদ্ধা। এই বাড়ির পুজো যেহেতু তন্ত্র মতে হয় সেহেতু পশুবলীর নিয়ম আছে। বর্তমানে সব বাড়িতে পশুবলী হয় না শুধুমাত্র ন বাড়িতেই হয়। এই বাড়ির পুজোর প্রসাদ সব বাড়িতে বিলি করার নিয়ম। বিসর্জনের ও কিছু বিশেষ নিয়ম কানুন আছে। নৌকা বিহার করে দেবীর বিসর্জনের ব্যবস্থা করা হয়। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ এই পুজোয় অংশ নেয় আগের জাঁকজমক কমলেও রীতিনীতি ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়।


কালী গঞ্জ ব্লকের মাটিয়ারি গ্রামের রাম সীতার বাড়ি পুজো

কালীগঞ্জ ব্লকের মাটিয়ারি গ্রামের পৌনে তিনশো বছরের এই বাড়ির পুজোতে আছে আজব নিয়ম। প্রতিবছর বিসর্জনের পর তিনটে টিকটিকি আসে। যতক্ষণ না টিকটিকি আসে প্রতিমা বিসর্জন সম্পূর্ণ হবে না। তারমধ্যে একটা টিকটিকি পকেটে করে এনো ঠাকুর দালানে ছেড়ে দেওয়া হয়। মনে করা হয় মায়ের প্রেরিত জীবটির দ্বারা সন্তান সন্ততিরা সুখে শান্তিতে থাকবে। রামনবমী তে এখানে বড় মেলা বসে। এই বাড়িকে রাম সীতার বাড়ি বলে সবাই। এছাড়া এই বাড়ির সকল পুরুষের নাম রাম দিয়ে শুরু এই বাড়ির পুজোর বয়স প্রায় আড়াইশো বছরের ও পুরোনো। বন্দুকের গুলি ছুঁড়ে সন্ধি পুজো শুরু হয়। এমন অনেক খুঁটিনাটি নিয়ম আছে। ভাগীরথী নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়।


বীরনগর মিত্র মুস্তাফিজ বাড়ির পুজো

বীরনগরের প্রাচীন নাম উলা।এই উলা নাম নিয়ে অনেক কাহিনী আছে।উলুবন পরিষ্কার করে জনবসতি গড়ে ওঠার ফলে এমন নাম।আবার অনেকেই বলে দেবী উলাই চন্ডীর নামে আবার কেউ কেউ বলে দুর্ধর্ষ ডাকাত দল ধরা পড়লে উলা থেকে নাম পাল্টে হয় বীরনগর। এখানকার জমিদারের মুস্তাফি বংশের প্রতিষ্ঠাতা রামেশ্বর মিত্র। মুস্তাফিদের কাঠের তৈরী কারুকার্য শোভিত একটি দুর্গা মণ্ডপ ছিল।
বাংলার বিভিন্ন স্থান থেকে এই মণ্ডপ দেখতে অনেক লোকের সমাগম ঘটে।কালের নিয়মে প্রায় বিনষ্ট হয়েছে পরে আবার নতুন করে তৈরী হয়েছে, বর্তমানে নতুন মণ্ডপেই দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হয়।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *